বাংলাদেশের সেরা চিকিৎসক জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম


জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম বাংলাদেশের অন্যতম সেরা চিকিত্সক। তিনি বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত চিকিত্সক ছিলেন। তাছাড়াও তিনি মাওলানা ভাসানী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, মাওলানা মো. আকরম খাঁ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সাংবাদিক আবদুল গণি হাজারী, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, সাংবাদিক নাসিরউদ্দীনসহ অসংখ্য মানুষের চিকিত্সা করে এতটাই সুনাম অর্জন করেছেন যে, দেশের অধিকাংশ লোক তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। ডা. নুরুল ইসলামকে নিয়ে কবি জসীমউদ্দীন ও সুফিয়া কামাল কবিতাও রচনা করেন। তিনি পিজি ইনস্টিটিউটকে প্রায় শূন্যাবস্থা থেকে সুদীর্ঘ বাইশ বছর ধরে তিলে তিলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসাধন্য একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়ন করে দেশ-বিদেশে সুনাম অর্জন করেছেন। ধূমপান নিবারণের জন্য ‘আধূনিক’ প্রতিষ্ঠা করে এর কার্যক্রম এতটা বিস্তৃত করেছেন যে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার মহাপরিচালক তিন বার বিশেষ পদক প্রদান করেছেন। চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে দেশ-বিদেশের ছাত্রছাত্রীরা চমত্কার পরিবেশে অত্যন্ত উঁচুমানের শিক্ষা গ্রহণ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ক্যাম্পাসে হাসপাতাল, অডিটোরিয়াম, আবাসিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাদি আছে। পঁচাশি বছর বয়সেও সচল থেকে ডা. ইসলাম দেশ ও জাতিকে নানাভাবে সেবা করে গেছেন।
জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম ১৯২৮ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ থানার মোহাস্মদপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সৈয়দুর রহমান ছিলেন স্কুলশিক্ষক। তিন ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। মাত্র চার বছর বয়সেই তাঁর পিতা সৈয়দুর রহমান ইন্তেকাল করেন। মা গুলমেহের, স্নেহপরায়ণ বড় ভাবি মোছাম্মত মোস্তফা খানম ও মেঝ ভাইয়ের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে নুরুল ইসলামের শৈশব ও কৈশোরকাল কেটেছে। বাড়ি বলতে একটা মাটির ঘর—প্রথমে ছন, পরবর্তী পর্যায়ে টিনের ছাউনি। সামনে
ছোট একটি দেউড়ি। বাংলাদেশের সাধারণ একটি গ্রামের অতি সাধারণ একটি পরিবারে ডা. ইসলামের মতো কীর্তিমান এক মানুষের জন্ম।
ছাত্রজীবনের প্রথম থেকেই নুরুল ইসলাম ভালো ছাত্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এসএসসি টেস্ট পরীক্ষায় তাঁর ফল দেখে হেডমাস্টার ও সহকারী হেডমাস্টার দুজনই খুব খুশি হয়েছিলেন। গাছবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৪৩ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেন।
বন্দিদশায় একদিন : এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার আগে তিনি কখনো শহর দেখেননি। এসএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরপরই তাই শহর দেখার ইচ্ছে জাগল মনে। সিনেমা সম্বন্ধে অনেক গল্প শুনেছেন। তাই একদিন বড় ভাবির কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে বন্ধু ওয়াদুদকে নিয়ে ট্রেনের
তৃতীয় শ্রেণির টিকেট কেটে সন্ধ্যা সাতটায় চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে পৌঁছান। জীবনে প্রথমবার বিজলি বাতি দেখে অবাক হয়ে যান। রাত ন’টার শোতে হিন্দি ছবি ‘শাদি’ দেখে পূর্বপরিচিত একজনের সঙ্গে ভিআইপি হোস্টেলে রাত্রিযাপন করেন। সকালে স্টেশনে গিয়ে দেখেন ট্রেন ছেড়ে
চলে গেছে। পরবর্তী ট্রেন দুপুর বারোটায়। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। চট্টগ্রাম থেকে অস্ত্র ও সৈন্য-সামন্ত নিয়ে বিশেষ ট্রেন দোহাজারী যাতায়াত করত। তাঁরা ভাবলেন ইংরেজ সাহেবদের বলে যদি বিশেষ ট্রেনে যাওয়া যায় তাহলে পয়সাও বাঁচবে, আগেও যাওয়া যাবে। কিন্তু ইংরেজ সাহেব গুপ্তচর সন্দেহ করে মিলিটারি জিপে করে তাদের দুজনকে থানায় নেয়ার নির্দেশ দেন। বিভিন্ন প্রশ্ন করে যখন তাঁরা সন্দেহমুক্ত হলেন, তখন বিকেলের ট্রেনে তাঁদেরকে গ্রামে পাঠিয়ে দেন।
এসএসসি পাস করার সময় তাঁর বড় ভাই কলকাতায় থাকতেন। তিনি নুরুল ইসলামকে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করে দেন। এইচএসসি পাসের পর তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এ পেশার লোকের সমাজে বিশেষ কদর ছিল বলে ছোটবেলা থেকেই ডাক্তারি পড়ার প্রতি ঝোঁক ছিল তাঁর।
ডাক্তারি পড়া অত্যন্ত ব্যয়বহুল। একটি এনাটমির বইয়ের দাম দিয়ে বিভিন্ন কোর্সের বা অন্য শাস্ত্রের সব বই কেনা যায়। তার ওপর নরকঙ্কাল, ডিসেকশন যন্ত্রপাতি ইত্যাদি কেনার জন্য বড় ভাইয়ের ছোট চাকরির সামান্য বেতনে খরচ মেটানো সম্ভব হতো না। প্রথমে থাকার ব্যবস্থা
হয়েছিল বিজলি বাতিহীন এক চিলেকোঠায়, পরে তাঁর মামার বাসায়। কোনোটিতেই পড়ার অনুকূল পরিবেশ ছিল না। আর্থিক কারণে হোস্টেলে থাকা সম্ভবপর হয়নি। শিয়ালদহ রেলস্টেশনের কাছে ওয়াকফ এস্টেটের তত্ত্বাবধানে ছাত্রাবাসে বিনাপয়সায় থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে শুনে অনেক চেষ্টা তদবির করে সেখানে উঠলেন। কিন্তু সেখানকার পরিবেশ তাঁর কাছে অসহনীয় ছিল। পরে স্যার আদমজীর সঙ্গে দেখা করেন বৃত্তির জন্য। তিনি মাসিক পঁয়ষট্টি টাকা হারে বৃত্তি এবং বই কেনার জন্য পাঁচশত টাকা মঞ্জুর করলে তাঁর মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার পথ সুগম হয়। এমবিবিএস পরীক্ষা দেন ১৯৫০ সালে। কাগজে কলমে লেখা আছে ১৯৫১ সালে পাস করা ডাক্তার। তিনি যখন পাস করেন তখন ইন্টার্নি কোর্স ছিল ছয় মাসের, যা এখন এক বছর।

কর্মজীবন
ডাক্তারি পাশ করার পর দুটো পথ খোলা ছিল—হয় সরকারি চাকরি, নতুবা হাউজ ফিজিশিয়ান হিসেবে প্রশিক্ষণ নেয়া। দেশ ভাগ হওয়ায় কলকাতায় চাকরি পাওয়ার প্রশ্নই ছিল না। এরমধ্যেই খবর পেলেন যে, ঢাকা মেডিকেল কলেজে কিছু সংখ্যক চাকরি খালি হয়েছে। ফিরে এলেন ঢাকায়। পেশাগত জীবনের প্রথম রোগী ছিলেন তাঁর নিজের মা। কারণ ঢাকায় ফেরার পরই তিনি তাঁর মায়ের গুরুতর অসুস্থতার খবর পান এবং বাড়ি ফিরে তাঁর জীবনের প্রথম চিকিত্সা দিয়ে তিনি তাঁর মাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন।
পিএসসির ইন্টারভিউ দিয়ে ১৯৫২ সালে মেধাতালিকার শীর্ষে থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বক্ষব্যাধি বিভাগের আউটডোরে নিয়োগ পান। ১৯৫৪ সালের পয়লা এপ্রিল লন্ডনের হুইটিংটন হাসপাতালে এমআরসিপি কোর্স শুরু হয়। এ কোর্সে যোগ দেয়ার জন্য সরকারি খরচে তিনি
সেখানে যান। মেডিসিনে প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর ১৯৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ে টিডিডি কোর্সে যোগদান করেন এবং সে বছর জুনে পরীক্ষা দেন। ছ’মাসের এ কোর্সে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। তত্কালীন সময়ে প্রথম সুযোগে এমআরসিপি পাস করত মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী। তিনি প্রথম সুযোগে পাস করার আনন্দে কান্না সংবরণ করতে পারেননি, আর এই আনন্দে ৫০ পাউন্ড পাঠিয়ে দেন তাঁর উচ্চবিদ্যালয় গাছবাড়িয়ায় এবং পাশের গ্রামের জোয়ারা উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের যন্ত্রপাতি কেনার জন্য। ১৯৫৬ সালের মার্চ মাসে তিনি দেশে ফিরে আসেন। তত্কালীন সারা পূর্ব পাকিস্তানে তিনিই ছিলেন তখন একমাত্র এমআরসিপি, টিডিডি। দেশে পৌঁছার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপকরা খুবই খুশি হন, কারণ বিগত কয়েক বছরে উচ্চ শিক্ষার জন্য যে কয়েকজনকে বিদেশে পাঠানো হয়েছিল, কোনো না কোনো কারণে কেউই কৃতকার্য হতে পারেননি। যথারীতি সার্জন জেনারেলের কাছে ফিরে আসার সংবাদ জানিয়ে দু’দিন পর দেখা করে তিনি জানালেন যে, সরাসরি এসোসিয়েট প্রফেসর বা প্রফেসর হবার ইচ্ছে তাঁর নেই। বরং ধাপে ধাপে ওঠার ইচ্ছে হিসেবে মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলে মেডিসিনের প্রভাষক হিসেবে যোগ দিতে পারলে তাঁর সুবিধা হয়। ডা. ইসলামের প্রস্তাবটি সার্জন জেনারেল অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করলেন এবং বললেন যে, পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রি নেয়ার পর কেউ সরাসরি অধ্যাপক হতে চায় না, তাঁর এটা প্রথম অভিজ্ঞতা হলো। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বহির্বিভাগে সুপি ডিউটিতে পোস্টিং করা হলো। ছয়মাস এভাবে কাজ করার পর মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলে মেডিসিনের প্রভাষক হিসেবে তিনি নিযুক্ত হন। একইসঙ্গে টিবি ওয়ার্ডের দায়িত্বও তাঁকে দেয়া হয়।
এ সময় তিনি ভিটামিন, টনিক, কোরামিন প্রভৃতি ওষুধ ব্যবহারের অযৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে সংবাদপত্রে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এটি ব্যবসায়ী এবং রোগীমহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরপর থেকে আজন্ম নিয়মিতভাবে তিনি লেখালেখি করেছেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান। তাঁর আগেই পক্ষপাতিত্ব করে তাঁর পরে পাস করেও দুজন এ পদে নিয়োগ পান। কিন্তু ১৯৬২ সালে তিনি তাঁদের আগে অধ্যাপক হিসেবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে নিয়োগ পেয়ে পূর্বের বঞ্চনা থেকে মুক্তি পান। চিকিত্সাবিজ্ঞানে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে তিনি সর্বপ্রথম ‘নাফিল্ড স্কলারশিপ’ পাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন ১৯৬৩ সালে। ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে বিলাতে কাজ করে ১৯৬৪ সালের মাঝামাঝি দেশে ফিরে আসেন। চাকরিজীবনের অল্প সময় (দু’বছর) নিজ জেলা চট্টগ্রামে অবস্থান করলেও সেখানকার স্মৃতি তাঁর কাছে মধুময় ও অম্লান হয়ে ছিল সারাজীবন। ১৯৬৫ সালে পোস্ট গ্রাজুয়েট চিকিত্সা মহাবিদ্যালয়ে যুগ্ম পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। কিন্তু তিনি শুধু প্রশাসক হিসেবে থাকতে চাননি। চিকিত্সক এবং অধ্যাপক হিসেবে যে সুনাম তিনি ইতোমধ্যে অর্জন করেছিলেন তা ধরে রাখার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে যুগ্ম পরিচালক ও অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগপত্র সংশোধন করান। ১৯৮৭ সালে পোস্ট গ্রাজুয়েট ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে তিনি প্রতিষ্ঠানটিকে নিজের মেধা, শ্রম ও মনন দিয়ে এমনভাবে গড়ে তোলেন যে এটি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষ অবদানের জন্য প্রশংসিত হয়েছে, স্বীকৃতি লাভ করেছে। সেই সাথে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিকিত্সক হিসেবে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

পারিবারিক জীবন
ডা. ইসলাম অধ্যাপক হিসেবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে বদলি হওয়ার পর ১৯৬২ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকা শিক্ষা সম্প্রসারণ কেন্দ্রের শিক্ষক আনোয়ারার সঙ্গে ঢাকায় তাঁর বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। তাঁদের তিন সন্তান আজ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পিতার মুখ উজ্জ্বল করেছেন। বড়
মেয়ে নূর-এ-জান্নাত আয়েশা ইসলাম দীনা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে প্রথম স্থান অধিকার করে এমবিএ অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স
অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রাম (ইউএসটিসি)-এর বিজনেস ফ্যাকাল্টির ডেপুটি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর। ছেলে আহমেদ ইফতেখারুল ইসলাম বিএ (অনার্স) এমএ লাভের পর ইউএসটিসি থেকে এমবিএ অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি জনসেবা ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব ট্রাস্টির ভাইস চেয়ারম্যান। ছোট মেয়ে এমবিবিএস, বিসিএস হেলথ, এফসিপিএস। বর্তমানে তিনি ইউএসটিসি-র একাডেমি অব ফ্যামিলি মেডিসিন-এর সহযোগী অধ্যাপক।

ক্ষেত্রভিত্তিক অবদান
জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামের অবদান সমাজ ও দেশে অপরিসীম। তিনি শুধু বিখ্যাত চিকিত্সকই নন, অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারীও বটে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর অবদান সংক্ষিপ্তভাবে নিম্নে দেয়া হলো :

জাতীয় যক্ষ্মা সমিতি
কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করার পর ডা. ইসলাম ওই কলেজের বক্ষ বিভাগে হাউজ ফিজিশিয়ান হিসেবে নিযুক্তি পান। সেখানে প্রশিক্ষণ পাওয়া ছাড়াও ওয়েলসের টিডিডি কোর্সে যক্ষ্মা ব্যাধির ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়ে পড়ানো হয়। তিনি মনে করেন, বিশ্ব
স্বাস্থ্য সংস্থার সাহায্য নিয়ে স্বেচ্ছাসেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমের সাহায্যে জনসাধারণকে বোঝাতে হবে এ রোগ সম্বন্ধে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৭ সালের শেষ দিকে কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে এক ঘরোয়া বৈঠকে যক্ষ্মার প্রকোপ থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য একটি সমিতি গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জাকির হোসেনকে সমিতির পৃষ্ঠপোষক হওয়ার অনুরোধ জানালে তিনি রাজি হন। তিনি সব ডিসির কাছে ডিও লেটার লেখেন যাতে প্রত্যেক জেলায় যক্ষ্মা সমিতি গঠন করে সারাদেশে আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দেশজুড়ে জেলা শাখা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন ডা. ইসলাম ও তাঁর সহযোগীরা।

জাতীয় ওষুধ নীতি
পাকিস্তান আমলে ওষুধের ষাট থেকে সত্তর শতাংশ আসত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশে ওষুধ-সঙ্কট তীব্র রূপ ধারণ করে। এ সমস্যা মোকাবিলার দায়িত্ব ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ-এর হলেও প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক কাঠামো এবং বিশেষজ্ঞের অভাবে অনেক অপ্রয়োজনীয় ওষুধ দেশে আসে। পক্ষান্তরে প্রয়োজনীয় অনেক ওষুধের অভাব দেখা দেয়। সরকার এ অবস্থা উপলব্ধি করে ১৯৭৩ সালের ১০ জুলাই ডা. নুরুল ইসলামকে চেয়ারম্যান করে সাত সদস্য বিশিষ্ট একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে অনেক ওষুধ ও মাদক-মিশ্রিত টনিক বাদ পড়ে। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী মহল কমিটির বিরুদ্ধে তত্পর হয়ে ওঠে এবং ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাতিল হওয়া ওষুধগুলো আবার বাজারে আসে। ১৯৮২ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ডা. ইসলামকে চেয়ারম্যান করে সরকার নতুন বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ১২ জুন ১৯৮২ তারিখে সরকার ওষুধ অধ্যাদেশ জারি করে। এই ওষুধ নীতি সারাবিশ্বে এক নজিরবিহীন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ওষুধ নীতিকে ‘সাহসী পদক্ষেপ’, ‘সবচেয়ে প্রয়োজনীয়’, ‘গৌরবময় দৃষ্টান্ত এবং ওষুধ নীতির ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা’ হিসেবে বিভিন্নজন আখ্যায়িত করেছেন। আবার অনেকেই বলেছেন, বাংলাদেশের ওষুধ নীতি হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রণীত অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ তালিকার একটা বাস্তব ও কল্যাণমুখী প্রয়োগ। বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তি, সমাজকর্মী, রাজনৈতিক নেতা, এমনকি বিশ্বের অনেক ধর্মীয় নেতাও এ ওষুধ নীতিকে স্বাগত জানিয়েছেন।

আইপিজিএমআর
১৯৬৪ সালের জুলাই মাসে পিজি ইনস্টিটিউটের প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বর্তমান ইমারজেন্সি ওয়ার্ড যেখানে অবস্থিত, এর পাশের খালি জায়গায় দুটো শেড তৈরি করে একটিতে লাইব্রেরি এবং অন্যটিতে অফিস ও লেকচার রুম স্থাপন করা হয়। ১৯৬৫ সালের ৬ ডিসেম্বর ডা. ইসলাম প্রথমে পোস্টগ্রাজুয়েট চিকিত্সা মহাবিদ্যালয়ের যুগ্ম-পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। পরে অনেক চেষ্টা করার পর তিনি অধ্যাপক এবং হাসপাতালের রোগীর চিকিত্সা করার দায়িত্বও পান। যুগ্ম-পরিচালক হিসেবে যোগদান করলেও তিনিই ছিলেন প্রথম পরিচালক।
স্যার জেমস কেমেরুন যোগদান করেছিলেন উপদেষ্টা হয়ে। প্রথম দিকে স্যার কেমেরুন, শামসুদ্দীন আহমদ ও তিনি—এই তিন জন সার্বক্ষণিক চিকিত্সক ছিলেন, আর সবাই ছিলেন খণ্ডকালীন দায়িত্বে। অবসরগ্রহণের বয়সের পর সরকার তাঁর চাকরির মেয়াদ দু’বছর বৃদ্ধি করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি অবসরগ্রহণ করেন। দীর্ঘ বাইশ বছর পিজিতে চাকরির মধ্যে বিশ বছর পরিচালক হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পরিচালনা করে তিনি দুটি টিনশেড ঘর থেকে একে বিশাল একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেন। এ সময়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজগুলো হলো ইনস্টিটিউট শাহবাগে স্থানান্তর, ভূতপূর্ব মুসলিম লীগ ভবন ইনস্টিটিউট কর্তৃক গ্রহণ, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক সেন্ট্রাল ব্লাড ট্রান্সফিউশন সার্ভিস উদ্বোধন, ইনস্টিটিউটের জন্য জমি অধিগ্রহণ, যুগোপযোগী কোর্স প্রবর্তন প্রভৃতি। এসব অবদানের জন্য লন্ডনের রয়েল সোসাইটি অব মেডিসিন থেকে প্রকাশিত ‘ট্রপিক্যাল ডক্টর’-এর একটি নিবন্ধে তাঁকে আইপিজিএমআর-এর ফাউন্ডিং ফাদার হিসেবে অভিহিত করা হয়।

‘আধূনিক’
ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় এক ধূমপায়ী বন্ধুর সান্নিধ্যে এসে ডা. ইসলাম ধূমপানে আসক্ত হয়ে পড়েন। উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময় বিলাতে তামাকবিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। অনেক চেষ্টা করে অবশেষে দ্বিতীয় বার বিলাতে অবস্থানের সময় তিনি ধূমপান তথা বিষপান বিসর্জন দিতে সমর্থ হন। ধূমপান বাদ দেয়ার সুফল উপলব্ধি করার পর জনগণকে সচেতন করার মানসে পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ প্রকাশ করা শুরু করেন। পরে একটা সংগঠন তৈরি করে তামাকবিরোধী আন্দোলন করার জন্য নিজে সভাপতি এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক এনায়েত উল্লাহ খানকে মহাসচিব করে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে ‘আধূনিক’ নামের সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। ‘আমরা ধূমপান নিবারণ করি’র সংক্ষিপ্ত রূপ ‘আধূনিক’ ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ বিভাগের রেজিস্ট্রেশন পায়। দেশের সকল জেলা এবং বেশ কিছু সংখ্যক উপজেলায় এর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ধূমপান বিরোধী আন্দোলনে ‘আধূনিক’-এর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ইসলামকে ১৯৯০, ১৯৯২ ও ২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পদক প্রদান করে।

ইউএসটিসি
১৯৮৯ সালের ১৩ মে মাত্র ৪২ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে ইনস্টিটিউট অব অ্যাপ্লায়েড হেলথ (আইএএইচএস)-এর যাত্রা শুরু হয়। তখন সম্বল ছিল দুটো টিন শেড এবং ছাত্রছাত্রীদের বসার বেঞ্চ, চেয়ার-টেবিল, ব্লাকবোর্ড ও একটি ওভারহেড প্রোজেক্টর। ১৯৯০ সালের ১২ জুলাই বাংলাদেশ মেডিকেল এবং ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) সাময়িক এবং ১৯৯৩ সালের ২৯ জুন স্থায়ীভাবে আইএএইচএস-কে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৯২ সালে সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট ঘোষণা করে। প্রোফেসর ইসলাম ইউএসটিসি’র পক্ষে সরকারের নিকট স্বীকৃতির জন্য আবেদন করার পরপরই ৯ নভেম্বর ১৯৯২ তারিখে সরকার একে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৯৩ সালের ২৪ জানুয়ারি ক্লাস শুরুর মাধ্যমে ইউএসটিসি’র আনুষ্ঠানিক অগ্রযাত্রার সূচনা হয়। এটি বেসরকারি খাতে প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজধানীর বাইরে প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। পরবর্তীতে এটি দেশের অন্যতম সেরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগ্যতা অর্জন করে। নেপাল, ভারত, শ্রীলঙ্কা পাকিস্তান, ভুটান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জডার্ন, মালয়েশিয়া, নরওয়ে, প্যালেস্টাইন ও সুদানের ছাত্রছাত্রী এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাকরছে।
কাজ করার অবদারস্বরূপ পেয়েছেন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অগণিত পুরস্কার। আর আজীবন এদেশের চিকিত্সাসেবা উন্নয়নে কাজ করে গেছেন।.